সময়টা ১৯৮৫ সাল। ক্ষমতায় স্বৈরাচারী এরশাদ। মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ সহ কয়েকজন তরুণ মাত্র চারুকলার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফিরে গেছেন নিজ শহর যশোরে। সেখানে গিয়ে তারা ‘চারুপীঠ’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। উদ্দেশ্য রঙ, পেন্সিল আর কাদামাটি দিয়ে শিশুদের শৈশব রাঙানো। এই চারুপীঠ থেকে তাঁদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। আর সেটা হয়েছিল যশোরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না।
কিন্তু শুরুটা হল কিভাবে? হুট করেই প্ল্যান হল: বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সবাই চৈত্রের শেষ রাতে পুরো যশোর শহর জুড়ে আলপনা আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আরও প্ল্যান হল একটা মিছিল বের হবে: একটা শোভাযাত্রা। কেউ জানতেন না যে তাঁদের এই শোভাযাত্রা একদিন জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে। স্বীকৃতি পাবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হবে।
তো শোভাযাত্রার জন্য জিনিসপত্র বানানো শুরু হল। মাহবুব জামাল বানালেন পরী আর পাখি। হিরণ্ময় তৈরি করলেন বাঘের মুখোশ। পরদিন ভোর বেলায় যশোর শহর দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য! একদল ছেলে মেয়ে পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে সানাইয়ের সুরে, ঢাকের তালে মুখোশ আর ফেস্টুন নিয়ে নেচে গেয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এভাবেই জন্ম হল মঙ্গল শোভাযাত্রার। শুরুতে যে উৎসবের নাম ছিল বর্ষবরণ শোভাযাত্রা।
পরের মঙ্গল শোভাযাত্রাটাও হল ঐ যশোরেই। এবার শহরের অন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও চারুপীঠের এই আয়োজনে যোগ দিল। গঠিত হল ‘বর্ষবরণ পরিষদ’। সাড়ে তিন হাজার মুখোশ, বড় একটি হাতি সহ আরও অনেক কিছু তৈরি করা হল। কিন্তু প্রশ্ন হল, যশোরের সেই শোভাযাত্রা কিভাবে সমগ্র বাংলাদেশের হয়ে উঠলো?
উত্তর হচ্ছে, মাহবুব জামাল ১৯৮৮ সালে পড়াশোনার জন্য আবার চারুকলায় ফিরে যান। তাঁর সঙ্গে ফিরে যান তাঁর চারুকলার অন্য বন্ধুরা যারা তাঁর সাথে যশোর চারুপীঠে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সহযোদ্ধা ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে চারুকলার শিক্ষার্থীদের মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন তারা।
আর এভাবেই ১৯৮৯ সালে বঙ্গাব্দ ১৩৯৬ বর্ষবরণের সময় শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রথম ঢাকায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম হয় ঐ বছরে। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার করেছিলেন চারুকলার পেইন্টিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সাইদুল হক জুইস। ‘লক্ষ্মীসরা’ ছিল সেই পোস্টারের প্রতিপাদ্য। তখন কেউ খুব ভালো মুখোশ বানাতে পারতেন না। অতঃপর দৃশ্যপটে হাজির হলেন তরুণ ঘোষ। বিদেশে মাস্টার্স করতে গিয়ে তিনি মুখোশ বানানো শিখে এসেছিলেন। ব্যাস আর কি লাগে!
শুধুমাত্র নিজেদের উৎসাহ আর ইচ্ছা থেকে সেই শোভাযাত্রা হয়েছিল। তারা নিজেরা নিজেরাই সব কাজ করলেন, পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করলেন। হুট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো এই আয়োজন নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল। মানুষের মুখে মুখে তখন এই শোভাযাত্রার আলাপ। পেপারে প্রকাশিত হল শোভাযাত্রার ফটো।
তার পরের বছর মানে ১৯৯০ সালে চারু শিল্পী সংসদ সহ নবীন-প্রবীণ সব চারুশিল্পী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ছিলেন সালেহ মাহমুদ, ফরিদুল কাদের, ফারুক এলাহী, সাখাওয়াত হোসেন, শহীদ আহমেদ সহ সকল স্বনামধন্য শিল্পী। আর তাঁদের সঙ্গে অংশ নেন চারুকলার তৎকালীন সকল ছাত্ররা।
সিদ্ধান্ত হল চারুকলার শিল্পীরা তাদের তৈরি করা মুখোশ, ভাস্কর্য নিয়ে থাকবেন শোভাযাত্রার একদম সামনের অংশে। কিন্তু এমন একটি অনুষ্ঠান করার মতো টাকা পয়সা তখন চারুশিল্পী সংসদের কাছে ছিল না। তাহলে উপায়?
তখন এগিয়ে আসলেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করলেন। আর সেই শোভাযাত্রার পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। প্রথমে নাম ঠিক করা হয়েছিল: বৈশাখী শোভাযাত্রা কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটাই চূড়ান্ত করা হল।
১৯৯১ সালে পুরো অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ঐ বছরই সবার অংশগ্রহণে একটি জাতীয় উৎসবের পরিকল্পনা শুরু হয়। সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।
১৯৯১ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল বিশালকায় হাতি সহ বেশ কিছু বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ দিয়ে তৈরি প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নিয়ে একদল ছেলে মেয়ে নাচে গানে উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার একদম সামনে রং ছাত্র ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের একটি কুমির। বাঁশ এবং নানা রং এর কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি।
১৯৯৩ সালের বর্ষবরণ ছিল বঙ্গাব্দ ১৪০০ সালের সূচনা। আর সে উপলক্ষ্যে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া সহ আরও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়।
১৯৯৩ সাল থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। আর এরপর দাবানলের মত সেটি ছড়িয়ে পরে পুরো বাংলাদেশে। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
এখন দেশের প্রায় সব জেলায় প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।