বাংলাদেশে নেকড়ে? এমন কথা তো কোনদিন শোনা যায় নাই। ঘটনাটা কি? ঘটনার সূত্রপাত এ বছরের জুনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছবি থেকে। ছবিটিতে দেখা যায় কুকুরের মত একটি প্রাণীকে পিটিয়ে মেরে বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে সুন্দরবন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম তালতলিতে।
“গল্পের শুরু এখান থেকেই”, বলছিলেন মুনতাসির আকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জীববিজ্ঞানীর কাছে কুকুরের মত দেখতে প্রাণীটির মৃতদেহ সবার প্রথমে যে খটকাটি লাগায় তা হল, “এর গাল এবং গলা জুড়ে সাদা দাগ।”
প্রাথমিক ভাবে আকাশের অনুমান এটা কুকুর নয় , নেকড়ে। নিজের অনুমানের কথা জানিয়ে সে তার দুই সহযোগী জেন ক্যামলার ও উইলিয়াম ডাকওয়ার্থ কে মেইল করে এবং উভয়েই আকাশের সাথে একমত পোষণ করে জানায় যে এই মৃতপ্রাণীটি একটি পুরুষ নেকড়ে। কিন্তু সমস্যাটা হল বাংলাদেশে কোন নেকড়ে নেই। তথ্যসূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে নেকড়ে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৪৯ সালে।
নিজের এই অনুমানের কথা আকাশ তার আরো কিছু সহযোগীর সাথে আলোচনা করে, যাদের অনেকে এটিকে “ গোল্ডেন জ্যাকেল” বলে অবিহিত করেন। বলে রাখা ভাল “গোল্ডেন জ্যাকেল” ও বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, কুকুর ভেবে যে প্রানীটিকে মেরে ফেলা হয়েছে তা আদতে কুকুর নয়।
আরও গভীরে জানার জন্য আকাশ তৎকালীন বরগুনা জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে আরও কিছু অপ্রকাশিত ছবি সংগ্রহ করেন, এই ছবিগুলো মূলত প্রানীটিকে মেরে ফেলার ঠিক পরমুহূর্তে তোলা হয়েছিল। এই নতুন ছবিগুলো আকাশ ও তার অন্যান্য সহযোগীদের অনুমানকে আরও দৃঢ় করে যে এই প্রানীটি একটি ভারতীয় নেকড়ে(Canis lupus pallipes) যেটা কিনা বিখ্যাত গ্রে উলফ(Canis Lupus) এর একটি প্রজাতি। গ্রে উলফ, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি প্রাণী। যাদের উদ্ভব ঘটেছিল প্লাইস্টোসিন যুগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে।
পরের দিন সন্ধ্যায় আকাশ ঢাকা থেকে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম তালতলীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
মৃতদেহ উত্তোলন
তালতলী পৌঁছানোটা মোটেও সহজ ছিল না। প্রথমে নৌকা, এরপর কিছুদূর রিকশা ও মোটর বাইকে গিয়ে তারপর আবার নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে কিছুদূর হেঁটে তৃতীয় বারের মত নৌকায় উঠে তালতলীতে পৌঁছাতে হয়। আকাশ যখন তালতলীতে পৌঁছায় তখন পরেরদিন দুপুর।
সেখানে গিয়ে আকাশ জানতে পারলেন প্রায় দিন সাতেক আগে প্রাণীটিকে মেরে পাশের স্থানীয় বন বিভাগের অফিসের কাছে পুঁতে ফেলা হয়। বনবিভাগের এক কর্মীর সহায়তায় এই রহস্যময় প্রানীটির মৃতদেহ পুনরায় উত্তোলন করা হল।
“খুলিটা প্রথম দেখেই আমার ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হল”, বলছিলেন আকাশ। “ এটা কোনভাবেই শিয়াল বা অন্য কোন প্রজাতির কুকুর হতে পারে না। আমি নিশ্চিত এটা নেকড়ে।”
সপ্তাহখানিকের ব্যবধানে মৃতদেহে পচন ধরেছিল, আকাশের মতে মৃতদেহ কিছুটা নরম হয়ে গেলেও পুরো শরীর একসাথে ছিল।
ডি এন এ পরিক্ষার জন্য চুল আর পায়ের টিস্যুর নমুনা নেয়া হল। জুলাই মাসে ডি এন এ পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিত করল যে এটি কোন শেয়াল নয়, এটি ছিল একটি নেকড়ে। বাংলাদেশের নেকড়ে।
“একটি নেকড়ে কে পিটিয়ে মেরে ফেলা আমাদের দেশের রীতি অনুসারে মোটেও নতুন কিছু নয়। বন্য এবং দেখতে বিড়াল বা কুকুরের মত প্রানীগুলোকে ধরে মেরে ফেলা এদেশের অনেক পুরাতন রীতি। বিশেষ করে খাটাশ আর মেছো বিড়াল এই নৃশংসতার স্বীকার হয় সবচেয়ে বেশি”, বলছিলেন আকাশ। এর সাথে আরো যোগ করলেন যে, বন্য প্রাণী নিধন নিয়ে সামাজিক সচেতনতা কিছুটা সৃষ্টি হলেও, এই নৃশংসতা কমাতে পেরেছে কেবল ওই বাঘের বেলাতেই।
ম্যানগ্রোভের নেকড়ে ?
আসলে বাংলাদেশে নয় বরং সুন্দরবনেও নেকড়ে থাকার সম্ভাবনা অনেক কম। ভারতীয় নেকড়ে রা মূলত ঝোপঝাড়, পাতাঝড়া বন এবং জঙ্গল আর কৃষিজ জমির মাঝামাঝি জায়গা গুলোতে বসবাস করে। তাই এরকম ঘন , জল-কাদা যুক্ত ম্যানগ্রোভ বনে নেকড়ের সন্ধান পাওয়াটা একরকম আশ্চর্যেরই ছিল। কিন্তু এরকম ঘটনা এবারই প্রথম নয়, ২০১৭ সালে আলোকচিত্রী রিদ্ধি মুখার্জি সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে একটি নেকড়ের ছবি তুলেছিলেন। মজার ব্যাপার হল যে জায়গায় তিনি নেকড়ে টাকে পেয়েছিলেন সেটা ছিল নেকড়েদের বাসস্থানের জন্য পরিচিত পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে।
“২০১৭ সালের ওই নেকড়ের খবর আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল”, আকাশের মতে মাঝে মাঝে পশুরা এরকম কান্ড করে থাকে। ফলে তাদেরকে এমন এমন জায়গায় দেখা যায় যেখানে তাদের থাকার কথা না। ভারতীয় নেকড়েদের এরকম গুণের কথা আগেও শোনা গিয়েছে।
তাহলে কি তার মানে এটা দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশে পাওয়া নেকড়েটা আসলে আজ থেকে দুবছর আগে রিদ্ধি মুখার্জির ক্যামেরায় ধরা সে নেকড়েটাই? এটা শুধু ওই একটা নির্দিষ্ট নেকড়েরই কান্ড বৈ কিছু নয় ? আকাশের কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না।
“এটা অবশ্যই সেই নেকড়ে নয়, এটা হতে পারে না। এটা সত্য যে নেকড়েরা অনেক দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু সুন্দরবন, যেটা কিনা একটি কাটাযুক্ত ভূমি, এবং অসংখ্য ছোট বড় নদীর সমাহারে পরিপূর্ণ সেখানে এমন ঘটনা কাল্পনিক। ওই নেকড়েটিকে তালতলী আসতে হলে মোটামুটি পুরো সুন্দরবন পাড়ি দিতে হবে। সেই সাথে অতিক্রম করতে হবে এই বনের অন্যতম বড় একটি নদী এবং বেশ কয়েকটি লোকালয়। এই দূরত্ব অতিক্রম করা অসম্ভব।”
স্থানীয় সাংবাদিক হায়রাজ মাঝির কাছ থেকে জানা যায় নেকড়েটির সাথে স্থানীয়দের সমস্যা শুরু হয় মে মাসের শুরুর দিকে অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় ফনী এই এলাকা অতিক্রম করার পর থেকে। হঠাৎ করেই গ্রামের গবাদি পশুগুলো এক অচেনা প্রাণীর আক্রমণের স্বীকার হওয়া শুরু করে। একটি বাছুর মারা পড়ে। অনেকে বলাবলি করতে থাকে এটা বাঘের কাজ। কিন্তু একটি কুকুরের মত দেখতে প্রাণীকে বার চারেক লোকালয়ে দেখা গেছে বলে জানা যায়। এরপর একদিন গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে সেটিকে ধরে এবং মেরে ফেলে।
আকাশের বিশ্বাস এই নেকড়েটি ঘূর্ণিঝড় ফনীর কবলে পড়েই সুন্দরবনের এই গহীন এলাকায় চলে আসে, এবং আশ্রয় নেয় টেংরাগিরি অভয়ারণ্যে। ধরা পরার আগ পর্যন্ত সেটা ওখানেই থাকত আর খাবারের জন্য আসত লোকালয়ে।
একটা নেকড়ের দল টেংরাগিরি অভয়ারণ্যে আছে এটা আকাশ মানতে পারছিলেন না। কেননা টেংরাগিরি জঙ্গলে কোন হরিণ নেই, এবং আশেপাশের লোকালয় গুলোও সাম্প্রতিক কালে পশুদের মধ্যে কোন মারামারি বা সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেনি। হরিণ যেহেতু নেই সেহেতু সেখানে নেকড়েদের প্রয়োজনীয় খাবারের সংকট রয়েছে অর্থাৎ সেখানে সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনাও প্রবল। কিন্তু সেরকম কিছু লক্ষ্য করা যায় নি। আবার এটাই যে একমাত্র নেকড়ে সে ধারণাটিও মানতে পারছিলেন না। তার কাছে এটা ছিল একটি মূল্যবান সূত্র যা ধরে এগিয়ে হয়ত সম্ভাবনাময় কিছু পাওয়া যেতে পারে।
“সুন্দরবনে অবশ্যই নেকড়েদের বসবাস রয়েছে” বলছিলেন আকাশ। তিনি এও বললেন যে তিনি বিশ্বাস করেন এই নেকড়েরা এর আগেও অনেকবার ক্যামেরা-ট্র্যাপ সার্ভে তে ধরা পড়েছে যেটা কিনা বিগত পাঁচ বছর ধরে করা হচ্ছে বাঘ গণনা করার জন্য। হয়ত সেখানে নেকড়েগুলোকে সাধারণ শেয়াল ভেবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বর্তমানে আকাশ সেই ক্যামেরা- ট্র্যাপ সার্ভের ছবিগুলো বনবিভাগ থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মুগলির নেকড়েরা
সুন্দরবনে যে নেকড়েদের প্রজননস্থল আছে এ বিষয়ে অবশ্য সকল অভিজ্ঞদের একমতে আসা সম্ভব হয়নি। ইরাবতী মাঞ্জগাওকার, একজন বন্যপ্রাণী গবেষক যিনি ভারতীয় মানুষদের সাথে নেকড়েদের সম্পর্ক, আচরণ নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, সুন্দরবনে নেকড়েদের বসবাস থাকাটা মোটামুটি অসম্ভব।
তার মতে, ”এই প্রাণীটি সম্ভবত সুন্দরবনের খুব কাছাকাছি থাকত। এভাবে হয়ত সে ম্যানগ্রোভীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং বনের মাঝে ঢুকে পড়ে ও হারিয়ে যায়।”
তার মতে এটা আসলেই জানা অসম্ভব যে কতদিন ধরে নেকড়েটি সুন্দরবনে বসবাস করে আসছিল এবং আসলেই কি এটি হারিয়ে গিয়েছিল নাকি নতুন বাসস্থান, নতুন সঙ্গীর খোঁজ করছিল।
মাঞ্জগাওকার মনে করেন এই নেকড়েটি ২০১৭ সালে ভারতীয় অংশে দেখতে পাওয়া নেকড়টিও হতে পারে কিন্তু সেক্ষেত্রে এটা হবে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। একটা নেকড়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য পুরো ম্যানগ্রোভ বন ঘুরে বেড়াবে এটা আসলেই বিস্ময়কর।
সুন্দরবন নেকড়েদের বসবাসের জন্য আদর্শ জায়গা নয়। কিন্তু মাঞ্জগাওকার এটাও স্বীকার করলেন যে ভারতীয় নেকড়েরা সময়ের সাথে সাথে তাদের শিকার এবং বাসস্থান দুটোই হারাচ্ছে।
“ তবে, প্রাণীরা তাদের বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পরিবেশ এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। পরিবর্তন আনতে পারে তাদের প্রচলিত স্বভাবেরও” বলছিলেন মাঞ্জগাওকার।
ভারতের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে ভারতে দু থেকে তিন হাজার নেকড়ের বসবাস রয়েছে। যদিও মাঞ্জগাওকার একে আমলে নিতে চান না। তার ধারণা সংখ্যাটা আরও কম।
ছদ্মবেশে নেকড়ে?
সুন্দরবনে নেকড়ে মোটেও নতুন কিছু নয়। ১৯৫৩ সালে এক শিকারী নোয়াখালিতে একটি নেকড়ে শিকার করেছেন বলে দাবি করেন। সেই জায়গাটিও ছিল সুন্দরবনের খুব কাছে।
“আমার মনে হয় সে শিকারি ঠিক বলেছিলেন”, আকাশের দাবি। “এটা প্রচলিত আছে যে সুন্দরবনের শেয়ালেরা নাকি বাঘের ভয়ে ডাকে না। কে জানে এটা কোন ‘শেয়াল’?”
হয়ত তারা বেঁচে থাকার জন্যই নিজেদের প্রচলিত স্বভাবে পরিবর্তন এনেছে। হয়ত তারা শেয়াল সেজে সকলকে বোকা বানায় শুধু বেঁচে থাকার জন্য। হতেই পারে।
যদি আকাশের অনুমান সঠিক হয় তাহলে এই নেকড়েরা হয়ত বেঁচে থাকার তাগিদেই সুন্দরবনের মত অপেক্ষাকৃত কম সহনীয় পরিবেশকে বেছে নিয়েছে। হয়ত সুন্দরবন কম সহনীয় কিন্তু বেশি নিরাপদ। আর তাই ভারতীয় নেকড়েরা মানুষের হাত থেকে বাঁচতে নতুন কৌশল হিসেবে সুন্দরবনের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে চাইছে।
আকাশ মনে করেন এখনই উপযুক্ত সময়। ক্যামেরা- ট্র্যাপ ও বনাঞ্চলের আশেপাশের লোকালয়ের মানুষের সাথে কথা বলে সুন্দরবনে নেকড়েদের বাসস্থান আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। যদি সত্যিই সেখানে নেকড়েদের বাসস্থানের সন্ধান পাওয়া যায় তবে তাদের সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে।
যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে এরাই হবে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নেকড়ের দল যারা ম্যানগ্রোভে বসবাস করে। এই জাতটি হবে নেকড়েদের মধ্যে সবচেয়ে টেকসই ও সহনশীল। কেননা সুন্দরবনের প্রতিকূল পরিবেশকে তারা জয় করেছে।
আকাশ তো বলেই ফেললেন, ”এদের সংরক্ষণের জন্য আমি সবকিছু বাজি রাখতে রাজি।”
তথ্যসূত্র: https://news.mongabay.com/2019/08/the-wolf-of-bangladesh-a-true-story/
প্রায় ১০/১২ বছর আগে সাভারের একটি ঝোপঝাড় পূর্ণ নিরিবিলি এলাকায় সাইক্লিং করার সময় ইন্ডিয়ান নেকড়ের মত দেখতে একটি প্রানীকে রোদ পোহাতে দেখেছি।আমি ওটাকে শিয়াল ভেবেছিলাম বাট এত বড় চকচকে রংয়ের শিয়াল তার আগে পরে আর দেখিনি।